হারুন সালেমের মাঝি - মহাশ্বেতা দেবী
▶ লেখক পরিচিতি :
বাংলা সাহিত্যের একজন বিখ্যাত লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী। তিনি ১৪ই জানুয়ারি ১৯২৬ সালে বাংলাদেশের ঢাকা শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি পড়াশোনা করেছিলেন রাজশাহি, কলকাতার আশুতোষ কলেজ এবং পরে বিশ্বভারতীতে। ইংরেজি সাহিত্যে এম. এ পাস করেছিলেন তিনি। তিনি বিভিন্ন স্কুল, কলেজে শিক্ষকতা করেছিলেন, পাশাপাশি সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন। অবশেষে ১৯৮০ সাল থেকে তিনি সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন। তিনি অনেক পুরষ্কার পেয়েছিলেন যেমন: ম্যাগসেসাই, জ্ঞানপীঠ এবং সাহিত্য আকাদেমিসহ নানা পুরষ্কার। এছাড়াও তিনি অলংকৃত হয়েছিলেন দেশিকোত্তম ও পদ্মশ্রী উপাধিতে। তিনি ২৮ জুলাই ২০১৬ সালে কলকাতায় মারা যান।
▶ 'হারুন সালেমের মাঝি' গল্পের উৎস :
মহাশ্বেতা দেবীর লেখা একটি গুরুত্বপূর্ণ গল্প হল 'হারুন সালেমের মাঝি'। এই গল্পটি মহাশ্বেতা দেবীর 'স্তন্যদায়িনী ও অন্যান্য গল্প' নামে গল্প-সংকলন থেকে নেওয়া।
হারুন সালেমের মাঝি গল্প Class 12 | Harun Salemer Majhi Golpo Class 12
▶ 'হারুন সালেমের মাঝি' গল্পের সংক্ষিপ্ত বিষয়বস্তু :
গৌরবি অজ পাড়াগাঁয়ে, জীর্ণ এক কুঁড়েঘরে বাস করেন। তার স্বামী নেই এবং মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। গৌরবিকে ছেলে দেখে না, ছেলে থাকে অন্য জায়গায়। গৌরবি জন্ম-খোঁড়া। প্রতিবেশী হারার মায়ের ওপর গুগলি, শাক, পাতা তোলার জন্য তাকে নির্ভর করতে হয়। এইসব শাক-গুগলি সে বিক্রি করে যশির (যশোদার) কাছে। গল্পের শুরুতে দেখা যায় মুসলমান সন্তান রুগ্ন হারা গৌরবি মাসিকে জানায়, তার মা ডাকলে সাড়া দিচ্ছে না।
হারা, অনাথ হয়ে গেল। তার কাকা এই অনাথ শিশুর দায়িত্ব নিতে রাজি নয়। তাই হারা গৌরবির কাছে চলে এল । হারা বুঝতে পারল, গৌরবিই তার ভরসা। এই গৌরবিই তার আসল মাসি। অগত্যা গৌরবি তাকে আশ্রয় দিল। নিজে একগাল খুদ খেল ও হারাকেও কিছুটা দিল। চাটাই পেতে তারা শুয়ে পড়ল এবং ভাবতে লাগল গৌরবি। মা-বাপ হারা কি সত্যিই তার কাছে থাকতে এসেছে? তাহলে তো মহাবিপদ। তার নিজের পেট চলে না,আবার পরের জমিতে বাস, তার ওপর মুসলমানের ছেলে।- গৌরবি খুবই ফাঁপরে পড়ে গেল।
গৌরবি দেখে, হারা ঘুমের মধ্যে ফোঁপাচ্ছে। গৌরবি হারাকে ডেকে পাশ ফিরে শুতে বলে। এর পর হারার পাশেই গৌরবি শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে। গৌরবি স্বপ্ন দেখে হারার মা তার হাত ধরে এক অপূর্ব স্বর্গীয়দেশে নিয়ে গেছে, যেখানে কত থানকুনি, দূর্বা। আর মাদার গাছের ছায়ায় কত ঢেঁকিশাক।
গৌরবি সকালে উঠে হারাকে পাঠায় যশিকে এই খবর দিতে যে, সে যেন একবার গৌরবির সঙ্গে দেখা করে। আর হারা যেন খালপাড় থেকে থানকুনি পাতা তুলে আনে। আর কেউ জিজ্ঞেস করলে সে যেন বলে, মাসির উঠোনে সে শুয়ে ছিল। ঘরে নয়। গৌরবি পরম স্নেহে হাঁড়ির মধ্যে পড়ে থাকা মিয়োনো চালভাজা কুড়িয়ে-বাড়িয়ে একটা ছোট্ট পোটলা করে হারার হাতে দিয়ে বলে, সে এই খাবার খেয়ে যেন জল খায়।
হারা যায় খালপাড়ে। এদিকে গৌরবি ঘর গেরোস্থালির কাজ সেরে দেখে তার ভাঁড়ারে অল্পই চাল আছে। চাল, ডুমুর, মোচার কচি ফুল নুন দিয়ে উনুনে চাপিয়ে গৌরবি ভাবতে থাকে, কী করে সে হারার সঙ্গে এক সথে খাবে। এখন থেকে সেই বা কেমন করে জাতধর্ম বজায় রাখবে? তার সমাজের লোকই বা তাকে কী বলবে। -গৌরবি বড়ো সমস্যায় পড়ে যায়।
শেষে অনেক ভেবেচিন্তে গৌরবি নিজের ছেলের কাছে যায়। ছেলে নারায়ণ বিবাহিত। ভালো অবস্থা। সেখানে গিয়ে আশ্রয় পেলে মন্দ হয় না, এই ভেবেই ছেলের কাছে যাওয়া। ছেলে সে সময় বাড়িতে ছিল না-ছেলের বউ বেশ ভালো ব্যবহারই করে। চা-জল দেয়, দু'টো টাকা ও একটা কাপড় দেয়। গৌরবি বউয়ের কাছে এক'শ টাকা নেবার জন্যে আবদার করে বসে। সে একটা গোরু কিনবে। দুধ ঘুঁটে বেচে তাদের দুটি প্রাণীর তাতে চলে যাবে। দুটি প্রাণী শুনে বউয়ের প্রশ্নে হারার কথা এসে পড়ে। পরে ছেলে নিবারণ বাড়ি ফিরে আসে, সব কথা শুনে তো নিবারণ মায়ের ওপর বেজায় খাপ্পা। সে শিগগির মুসলমানের ছেলেটাকে বিদেয় করতে বলে। পাপটাকে বিদেয় করে মা চলে আসুক তার কাছে। এই প্রসঙ্গে গৌরবি তার ছেলেকে হারার একটা ব্যবস্থা করে দিতে বলে। নিবারণ বলে, ওকে ওর জায়গায় পাঠিয়ে দিতে হবে, অর্থাৎ মুসলমানদের দেশে-ওদের সমাজে। সেখানে হারা মরলে মরবে বাঁচলে বাঁচবে। এই শত্রুকে বিদেয় করতে হবে। এর পরে এ-কথা সে-কথায় ছেলে আর ছেলে বউয়ের মধ্যে ভীষণ ঝগড়া বেধে যায়।
যাই হোক, হারাকে ছেড়ে গৌরবি নিজের ছেলের কাছে থাকতে চায় না, তাই সে ছেলের বাড়ি থেকে চলে আসে। হারাকে নিয়ে ফিরে আসে তার সেই অন্ধকার কুঁড়েতে। নিজের ঘরে শোয়, হারাকে শোয়ায় দাওয়ায়। কিন্তু লোককে বানিয়ে বলে যে হারা শোয় উঠোনে। জাতিধর্মের ব্যাপারটি সে ভুলতে চায়। ইতিমধ্যে যশি ওরফে যশোদার সঙ্গে কথা হয় গৌরবির। যশি ব্যাপারটি সহজ করে দিয়ে বলে, হারাকে শহরে গিয়ে ছেড়ে দিয়ে এলেই ভালো হয়। সেখানে সে ভিক্ষে করে খাবে। যশির এই প্রস্তাব মানতে পারে না গৌরবি।
কদিন পরে মুকুন্দ আসে পিসির কাছে। তার ঘরেতে গৌরবির বাস। সে এসে হারাকে বিদেয় করে ছেলের কাছে গৌরবিকে চলে যেতে বলে। পালবাবুদের কাছে সে তার এ ভিটেটা বেচে দেবে, তারা এ ঘরে গুদাম বানাবে। একটা মুসলমান ছেলেকে তার পিসি ঘরে তুলেছে শুনলে পালবাবুরা রেগে যাবে। তাদের ঘরে পুজো-আচ্চা আছে। এ বাড়ি গৌরবিকে ছেড়ে দিতে হবে বলে মুকুন্দ পিসির কোনো কথা আর কানে নেয় না।
দিশেহারা গৌরবি রেগে গিয়ে হারাকে দূর করে দেয়। হারা ভয় পেয়ে নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যে হারা যেন মাকে কাছে পায়। হঠাৎই তার মনে হয়, কে যেন তাকে ঠেলছে। ঘুমের ঘোরে হারার প্রথমে মনে হয়েছিল এ যেন তার মা।
ঘুম ভাঙলে অন্ধকার ঘরে সে ভয় পেয়ে যায়। মাসি বলে চেঁচিয়ে ওঠে। গৌরবি তাড়াতাড়ি ভয় ভাঙানোর জন্যে জানায়, সে হল হারার মাসি। গৌরবি হারাকে তখন বলে যে তারা শহরে চলে যাবে। সেখানে গিয়ে তারা ফুটপাথে শোবে, ভিক্ষে করে দিন কাটাবে। সেখানে কেউ তাদের জাতের পরিচয় নিয়ে কথা বলবে না। এই ব্যবস্থায় দু'জনে কাছাকাছি থাকবে। ছাড়াছাড়ি হবে না।
পরিচয়হীন হয়ে বাঁচার জন্য চলে যায় শহরে। একবার শহরের জনসমুদ্রে মিশে যেতে পারলে জাতিধর্মের আর কোনো ভয় আর থাকবে না।
হারুন সালেমের মাঝি গল্প Class 12 | Harun Salemer Majhi Golpo Class 12
▶ 'হারুন সালেমের মাঝি' গল্পের প্রশ্ন ও উত্তর :
মহাশ্বেতা দেবীর লেখা 'হারুন সালেমের মাঝি' গল্পের খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তর গুলি দেখতে হলে, উপরের Menu Option এ ক্লিক করে দেখতে হবে।
▶ 'হারুন সালেমের মাঝি' গল্পের শব্দার্থ ও টীকা :
জলের ওপর ঠান্ডা সর ভাঙেনি-শীতকালে জলাশয়ের জলের ওপর পাতলা একটি সরের মতো আস্তরণ পড়ে থাকে। এখানে তার কথা বলা হয়েছে। নিড়িনি-ঘাস নিড়োবার হাতিয়ার বিশেষ। গৌরবির একখানা পা জন্ম থেকে খুঁতো-অর্থাৎ গৌরবি জন্মখোঁড়া। ঘরামি- ঘর ছাওয়ার মিস্ত্রি। হাঁসুলি- কাস্তের মতো নিয়ড়চাঁদা সাপ- বোড়াজাতীয় বিষাক্ত সাপ। আস্পর্ধা-ঔদ্ধত্য, অনুচিত সাহস। রিষ-হিংসা, দ্বেষ। জোগাড়ে- করিৎকর্মা; কাজের মানুষ। তল্লাট - এলাকা। জবরদখল-জোর করে দখল। ঘরটুনি-ঘরখানা মাত্র। রূপকথা-পরির দেশের গল্প। ওক্ত-সময়। আমানি-পান্তাভাতের জল। খজ্ঞডুমুর-হিন্দুদের পুজোর সময় যজ্ঞে লাগে, চলিত কথায় জগডুমুর। রমজান মাস -পবিত্র ঈদের আগে মুসলমানরা একমাস যাবৎ সারাদিন উপোস থেকে দিনের শেষে নির্দিষ্ট সময়ে উপবাস ভর্তা করে। লেংড়া-খোঁড়া। ড্যাংডেডিয়ে-মর্যাদার সলো, সগর্বে। যশিরা হাঁটে না, ছোটে-সকালে যশিরা শহরে মাল নিয়ে যায়, তাদের তাড়া থাকে গাড়ি ধরবার, তাই ছুটতে হয়। নিঃসঙ্গতা একাকিত্ব। বন্ন-বলল রুক্ষচুল-তেল হীন শুকনো চুল। মাদুলি-কবচ।ফোঁপাচ্ছে-ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ঢেঁকিশাক-এক ধরনের শাক যা স্যাঁতসেঁতে ভিজে জায়গায় জন্মায়। গাই বিয়োলে-গোরুর বাছুর হলে। বকনা বাছুর-মেয়ে বাচ্চুর। ষাঁড় বাছুর-এঁড়ে বাছুর। জাউ-ফেন ভাত। বেআক্কেল-অবিবেচক। হরতনী-তাসের হরতনের মতো, পানপাতার আকৃতি। গরজ-স্বার্থ, প্রয়োজন। ছোঁয়ানেপা-ছোঁয়াছুঁয়ি। সানকি-কলাই করা থালা বিশেষ। রীতকানুন-আইন। পোষ্টাভাত-দয়ার ভাত লাখোটা- লক্ষ লক্ষ। চাপাকল-টিউবওয়েল। ইলেটিরি- ইলেক্ট্রিক। ছিষ্টি-সৃষ্টি। বেজার-বিরক্ত। খটাশ-কটাশ। ঠাম্মা-ঠাকুরমা। মেলা বোকোনা-আজে বাজে অনেক কথা বলা। প্রাচিত্তির-প্রায়শ্চিত্ত। তিন সন্ধে ভাতের থালা মারতে পারে-তিনবার ভাত খেতে পারে। ধুন্ধুমার-প্রচণ্ড গোলমাল। কেরাচিনি-কেরোসিন। ভিটে-বসতবাড়ি। জুতো মশমশিয়ে-জুতো পরে চললে যে আওয়াজ হয়। দুর্ভোগ-দুঃখ, জ্বালা-যন্ত্রণা।হারুন সালেমের মাঝি গল্প Class 12 | Harun Salemer Majhi Golpo Class 12
▶ উপসংহার :
আলোচনা শেষে বলতে পারি দ্বাদশ শ্রেণীর চতুর্থ সেমিস্টার বাংলা বিষয়ের সাজেশন Pdf বই প্রকাশিত করা হয়েছে। বইটি পেতে হলে সরাসরি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। এই প্রতিবেদন গুলো যদি আপনাদের কাজে লাগে, তবে আমাদের পরিশ্রম সার্থক হবে।
SOCIAL MEDIA | FOLLOW |
---|---|
Whatsapp Group | Click Here |
Telegram | Click Here |
• Comment করো :(contact-form)
শুভেচ্ছা সহ,
WB Semester Team